আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। সেই বৈশাখ আসতে এখনো বেশ কয়েক মাস বাকি। এদিকে অগ্রহায়ন মাসেই পাবনা জেলার উপর দিয়ে বয়ে চলা ১৬টি নদ-নদী শুকিয়ে মরা নদীতে পরিনত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে নৌযোগাযোগ ও কৃষি খাতে। নদ-নদীর ওপর নির্ভরশীল প্রায় ১২ হাজার জেলে পরিবার কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাদের অনেকেই বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে।
জানা যায়, ১৯৬০ এর দশকে পাবনা জেলার বিভিন্ন নৌরুটে লঞ্চ ও নৌকা চলাচল করত। এখন জেলার নদীপথ বছরব্যাপী সচল থাকে না। নদী পথে যাতায়াত আগের মতোই এখনো সুলভ। প্রতি লিটার জ্বালানীতে নৌপথে ২১৭ টন মালামাল পরিবাহিত হয় এক কিলোমিটার পথ। অথচ সড়ক পথে ডিজেল চালিত ট্রাকে এক লিটার জ্বালানীতে এক টন মালামাল এক কিলোমিটার বহন করা যায়। নিয়মিত নদী ড্রেজিং না করায় নৌপথ কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। জেলায় সারা বছর কতটুকু নৌপথ চালু থাকে তারও জরিপ করা হয় না। ১২ মাস পানি থাকে এমন নদী পদ্মা ও যমুনাতে বিশাল বিশাল চর জেগে ওঠায় ঝুঁকি নিয়ে চলছে মালবাহী র্কাগোজাহাজ।
পাবনা জেলার পূর্ব প্রান্তে যমুনা নদী ৮০ মাইল সীমান্ত রচনা করে মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলাকে আলাদা করেছে। বর্তমানে চৈত্র মাসে যমুনায় বিশাল বিশাল চর ও বালিয়াড়ি জেগে উঠেছে। এ নদীতে বার মাস নৌযান চলাচল করতে পারে। কিন্তু শুস্ক মওসুমে বিঘ্ন ঘটে। নদীতে নাব্যতা থাকে না বলে স্থানে স্থানে ড্রেজিং করে নৌপথ চালু রাখা হয়। বছরের সব সময় এ নদী দিয়ে বড় মালবাহী জাহাজ, লঞ্চ ও নৌকা চলাচল করে। যমুনা নদী দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ। ইছামতির ৩০ কিলোমিটার পথ পরিত্যাক্ত হয়ে আছে। আগে বেড়া থেকে ভাঙ্গুড়ার বড়াল ব্রিজ পর্যন্ত লঞ্চ সার্ভিস চালু ছিল। সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। টিকে আছে কেবল কাজীরহাট পাটুরিয়া। জেলার বড়াল, গুমানী ও চন্দ্রাবতীতে বর্ষাকালে মালবাহী নৌকা চলাচল করে। কিন্তু অন্যান্য সময়ে নদীতে পানি থাকে না। ভরাট হয়ে গেছে আত্রাই নদী।
পাবনা জেলার দক্ষিণ পশ্চিম সীমানায় পদ্মা নদীর ৮০ কিলোমিটার, পূর্ব দিকে যমুনা নদীর ২৫ কিলোমিটার, উত্তর দিরে হুড়াসাগর নদের আট কিলোমিটার এবং বড়াল নদীর ২৫ কিলোমিটার নদীপথ কোনো মতে টিকে আছে। সামান্য নৌপথ রয়েছে গুমানী নদীতে। সুতিখালির পাঁচ কিলোমিটার নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে। রত্নাই, আত্রাই, চিকনাই, চন্দ্রাবতী, কাগেশ্বরী, বাদাই ও ইছামতি নদীতে বর্ষাকালে মাছ চাষ হয়। শুস্ক মওসুমে বিভিন্ন রকম ফসলের আবাদ হয়ে থাকে। জেলা প্রশাসন এসব নদী ইজারা দিয়ে থাকে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে রুকনাই, বারনাই, ট্যাপাগাড়ী, গোহালা, শালিকা, শুটকিদহ ও ভাঙ্গুড়ার ইছামতি নদী। ইছামতি নদীতে ৫০ কিলোমিটার নৌপথ ছিল। চিকনাই ৩৮ কিলোমিটার ও আত্রাই ৩০ কিলোমিটার। এখন এসব নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে।
বড়াল ও ইছামতি নদীর খাত সাঁথিয়ার বোয়ালমারীর কাছে দ্বিখন্ডিত হয়ে আত্রাই নামে পূর্ব দক্ষিন দিকে প্রবাহিত হয়ে পদ্মা নদীতে মিলিত হয়। এক সময় আত্রাই নদীতে প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। বিপুল পলিমাটির অবক্ষেপণে আত্রাই নদী ভরাট হয়ে যায়। জেলায় যাতায়াতের একমাত্র উপায় ছিল এই নদী পথ। বিশেষ করে বর্ষা ও শরৎকালে। বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভিন্ন স্থানে বাঁধ নির্মান করায় নদী পথ বন্ধ হয়ে গেছে। জেলার নৌরুটগুলোর বেশির ভাগ অংশ ক্রমাগত পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় পণ্যসামগ্রী আমদানি রফতানিতে ব্যবসায়ীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। কৃষিপণ্য আমদানি রফতানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা নির্ভরশীল হচ্ছেন সড়ক পথের ওপর।
ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহর উপজেলা মিলে বড়াল নদী রয়েছে মাত্র ২৫ কিলোমিটার। বসন্ত ও গ্রীস্মকালে পানি থাকে না। এ নদীর গভীরতা বর্তমানে তিন মিটার দাঁড়িয়েছে। চার মাসও নৌকা চলে না। গোমানী নদীর নাব্যতা থাকেনা পাঁচটি ঋতুতে। বাঘাবাড়ীর কাছে বড়াল ও করতোয়ার মিলিত প্রবাহ হুড়াসাগর নদ নামে পূর্ব দিকে এগিয়ে গেছে। বড়াল নদী পথে মিল্কভিটার সদস্যরা দুধ সরবরাহ করে থাকেন। কিন্তু নৌপথ অচল হয়ে পড়ায় তরল দুধ সরবরাহে তাদের চরম দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।