শফিউল আযম বিশেষ প্রতিনিধি বেড়া (পাবনা)বৃহত্তর চলনবিল অঞ্চলে চলতি রবি মওসুমে মসলা জাতীয় ফসল রসুন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছিল ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে ৩৯ হাজার ৬০৪ হেক্টর জমিতে। যা গত বছরের চেয়ে চার হাজার ৬০৪ হেক্টর বেশি। এবারের ক্ষণস্থায়ী বণ্যার পানি নেমে যাওয়ার পর বিণাচাষে রসুন বীজ রোপণ করেন। এতে রসুন বীজ রোপণ দেড় মাস আগেই শেষ হয়েছে। গত তিন বছর রসুনের দাম ভাল পাওয়ায় এ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে রসুন আবাদ বেড়ে গেছে। গত মওসুমের শুরু থেকেই রসুনের দাম বেড়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের চাষিরা রসুন চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। ফলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রসুন আবাদ বেশি হয়েছে বলে কৃষক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছে।
চলতি রবি মওসুমে বৃহত্তর চলনবিলের নাটোর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলায় রসুন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭২ হাজার টন। এবছর চলনবিল অঞ্চলের কৃষকরা রসুন আবাদে ব্যাপকভাবে ঝুঁকে পড়েন। এতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় চার হাজার ৬০৪ হেক্টর বেশি জমিতে রসুন হয়েছে বলে কৃষক ও কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। চলনবিলের মাঠে মাঠে এখন কৃষকরা তাদের স্ত্রী-পুত্রদের সাথে নিয়ে রসুন ক্ষেত পরিচর্যা করছেন।
পাবনা, নাটোর নওগাঁ ও সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ সুত্রে জানা যায়, দেশের উত্তরের বৃহত্তর চলনবিল অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি রসুন আবাদ ও উৎপাদন হয়। এ অঞ্চলের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, তাড়াশ ও রায়গঞ্জে রসুন অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর কৃষকরা বিনা চাষে রসুন আবাদ করেন। গত মওসুমে ভাল দাম পাওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকরা এবার রসুন চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। এবার বিল-নদী-খাড়িরর পানি আগেই নেমে যাওয়ায় কৃষকরা সময় মতো রসুন বীজ রোপণ করেছেন। যদি কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হয় তাহলে রসুনের ভালো ফলন পাওয়া যাবে বলে কৃষকরা আশা প্রকাশ করছেন।
মসলা জাতীয় ফসল রসুন উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত দেশের চলনবিল। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি রসুন আবাদ হয় বড়াইগ্রামের বাজিতপুর, মাড়িয়া, ইকড়ি, জালশুকা, তারানগর, শ্রীরামপুর, মানিকপুর, চকপাড়া, রয়না ভরট, মামুদপুর, রয়না, রোলভা, খাকসা, চড়ইকোল, গুরুদাসপুর উপজেলার ধারাবারিষা, কাছিকাটা, হাঁসমারী, দড়ি হাঁসমারী, শিধুলী, চড়কাদহ, মশিন্দা, চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা, কাটেঙ্গা, কোকড়াগাড়ি, ধানকুনিয়া, লাঙ্গলমোড়া, বরদানগর, ধুলাউড়ি, বোয়ালমারি, গৌরনগর, বিন্যাবাড়ি, নিমাইচড়া এলাকায়। চলনবিল অঞ্চলে বণ্যার পানি নেমে যাওয়ার পর পলিযুক্ত দোঁ-আশ ও এঁটেল দোঁ-আশ মাটি রসুন রোপন করা হয়। এতে খরচ কম ও ফলন বেশি পাওয়া যায়।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৫-৯৬ সালে নাটোরের বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলোর কৃষকেরা স্ব-উদ্যোগে প্রথম বিনা চাষে রসুন আবাদের প্রচলন করেন। এই রসুনের আবাদ বা চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বড়াইগ্রাম উপজেলার জালশুকা গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলম পূর্ণি জানান, চলনবিল অঞ্চলের জমিতে সাধারণত কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে নরম জমিতে বিনা চাষে রসুনের কোয়া রোপণ করা হয়। এ জন্য প্রচলিত নিয়মে জমি চাষ করার প্রয়োজন পড়ে না। এ পদ্ধতিতে ক্ষেতে আগাছা কম জন্মে। সার প্রযোগ করতে হয় কম। রোপণ থেকে উৎপাদণ পর্যন্ত ১২০ দিনের এই রসুন উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে পুরনো পদ্ধতির রসুন আবাদের চেয়ে অনেক কম। বিনা চাষ পদ্ধতিতে রসুনের ফলন বেশি হয়। প্রতি বিঘা জমিতে রসুনের ফলন হয় ২৫ থেকে ৩০ মণ। সাধারণত চৈত্র মাসে জমি থেকে রসুন তুলে আনা হয়।
নাটোরের বড়গ্রাম উপজেলা ভারপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল মজিদ বলেন, দোঁ-আশ ও এঁটেল দোঁ-আশ মাটি রসুন চাষের জন্য বেশি উপযোগী। এ কারণেই নাটোর জেলায় বিশেষ করে বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলায় সর্বাধিক জমিতে রসুন আবাদ হয়। চলতি মওসুমে এ এলাকায় লক্ষ্যমাত্রা চেয়ে বেশি জমিতে রসুন আবাদ হয়েছে বলে তিনি জানান।
পাবনা কৃষি স¤প্রসারন অধিদফতরের উপপরিচালাক ড. মোঃ জামাল উদ্দিন জানান, দোঁ-আশ ও এঁটেল দোঁ-আশ মাটি রসুন চাষের জন্য বেশি উপযোগী। এ কারণেই নাটোর জেলায় বিশেষ করে বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলায় সর্বাধিক জমিতে রসুন চাষ হয়। প্রতি বিঘা জমিতে ৩০ কেজি টিএসপি, ২৫ কেজি পটাশ ও ১৫ কেজি জিপসাম ছিটানোর দুই-একদিনের মধ্যে নরম জমিতে সারিবদ্ধভাবে রসুন বীজ রোপণ করতে হয়। রোপণের জন্য প্রতি বিঘা জমিতে দুই মণ রসুনের প্রয়োজন হয়। জমিতে রসুন রোপণের দিনই খড় বা বিচালী দিয়ে জমি ঢেকে দিতে হয়। বীজ রোপণের একমাস পরে পানি সেচ দিয়ে বিঘায় ১০ কেজি হারে ইউরিয়া ও পাঁচ কেজি হারে এমওপি ছিটিয়ে দিলে ফলন ভালো হয়।