শফিউল আযম,বিশেষ প্রতিনিধি বেড়া (পাবনা):ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর ভূমিদস্যুদের ধরার অপরাধে (উপসচিব) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ত্রয়োদশ ব্যাচ পরিচিত নং ৫৯৬৭ মোহা: আকবর আলীকে প্রোমোশন বঞ্চিত করা হয়েছে বার বার। তিনি ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তা। তার ব্যাচমেটরা এখন অধিকাংশই অতিরিক্ত সচিব নয়তঃ সচিব হিসবে কর্মরত আছেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনার ভূমিদস্যু দোসরদের ধরার অপরাধে ২০১৪ সালের ৬ মে বিভাগীয় মামলায় গাছ কাটার অভিযোগে তার দুই বছরের জন্য পদোন্নতি স্থগিতের আদেশ হয়। সেই হিসেবে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি কার্যকর হওয়ার সময় ০৮ /০২/২০১২ তারিখের পর মাত্র দুই বছর বাদ যাবার কথা ছিল। কিন্তু বর্ণিত ০৫.০০.০০০০.১৩০.১২.০০১.২৩-৩৯২ নম্বর প্রজ্ঞাপনে উক্ত আদেশের পূর্ববতী ৬ (ছয়) বছর বাদ দিয়ে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি কার্যকর হওয়ার তারিখ ২০/০২/২০১৮ নির্ধারণ করা হয়। যার দরুন তিনি আর কোন পদোন্নতি পাননি। তিনি উক্ত তারিখ সংশোধনের জন্য সিনিয়র সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করলেও অদ্যাবধি কোন অগ্রগতি হয়নি।
জানা যায়, তিনি ২০০৮ সালে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ঠাকুরগাঁও হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এসময় সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদায়ন না থাকায়, সরকারের বিধিবদ্ধ নির্দেশনা অনুযায়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে তাকেই সহকারী কমিশনার দায়িত্ব পালন করতে হতো। এসময় কাজী ফার্মের পক্ষ হতে ৫০ বিঘা জমির খারিজের প্রস্তাব করা হয়। তফশিলে উল্লিখিত মৌজার আর,ও,আর বহিতে দেখা যায়, ২ নং খতিয়ানটি সূচিতে আছে কিন্তু বাস্তবে নেই। এছাড়াও একই বহি সূচিপত্রে ২৪৯টি খতিয়ানের উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে ২৫২টি খতিয়ান রয়েছে। অর্থাত শেষের ২৫০, ২৫১ ও ২৫২ খতিয়ান তিনটি নূতন করে সংযোজন করা হয়েছে। আরও মজার কথা হচ্ছে, এই তিনটি খতিয়ানে জমির পরিমাণ হচ্ছে, ২০০.৮৪ একর এবং প্রতিটি খতিয়ানে জমির পরিমাণ ২০০বিঘার মত; যা ২/৩ জন কৃষকের নামে ১০০ বিঘা বা ৬০ বিঘা জমির মালিকানার (PO-98/PO-96) কোন সূত্রেই পড়ে না। তৎকালীন সার্ভেয়ার সুলতান আহমেদ(বর্তমানে কমিশনার অফিস, রাজশাহীতে কর্মরত) জানান যে, ২ নং খতিয়ানের পাতা ডিসি অফিস হতে আর.ও.আর. বহি সরবরাহ পাওয়ার পর হতেই ছিল না। তার বর্ণনানুযায়ী এই ২ নং খতিয়ানের পাতা জেলা প্রশাসকের রেকর্ডরুম, ইউনিয়ন ভূমি অফিস এমনকি জজ কোর্টের কপিতেও ছিল না। জরিপ বিভাগ থেকে এভাবেই আর.ও.আর. বহি সরবরাহ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন যাবরহাট ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আনিসুল হক থেকে একই কথা শোনা গেল (তিনি বর্তমানে চাকুরীতে কর্মরত আছেন)। তার মানে “কাজীর খতিয়ান সূচিপত্রে আছে, বহিতে নেই”। তাছাড়া খতিয়ানের প্রতিটি পৃষ্ঠায় দুই বার করে জরিপ বিভাগের অফিসিয়াল গোল সিল মারা হয়েছে। যা একদম অনভিপ্রেত। এর কারণ হচ্ছে, ২৫০, ২৫১, ২৫২ নং খতিয়ান তিনটি জালিয়াতি করে পরে প্রস্তুত করা হয়েছে। এটাকে গ্রহণযোগ্য করতে রাজস্ব অফিসারের এবং অফিসের মোট ২টি সীল বানানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি সীলেই কমপক্ষে ৫% গরমিল পাওয়া যায়। কালির রং এবং রাজস্ব অফিসারের স্বাক্ষরেও গরমিল পরিলক্ষিত হয়। এই হিসেবে ২৫০,২৫১ ও ২৫২ নং খতিয়ানে একই জাল সিল দুইবার করে ব্যবহার করা হয়েছে। চোখকে ফাঁকি দেয়ার জন্য, বাকি সমস্ত খতিয়ানে, জাল সিলও মারা হয়েছে।এই জালিয়াতি কাগজ পত্রের উপর ভিত্তি করে বর্ণিত তিনটি খতিয়ানের ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের আদেশ প্রদান করেন, এই ঘটনার পূর্বে সুধাংশ শেখর বিশ্বাস, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাঃ), ঠাকুরগাঁও। ঘটনাটি নিশ্চিত হবার পর সহকারী কমিশনার ভূমির পক্ষ হতে জমির খাজনা গ্রহণ বন্ধ করে দেয়া হয়, এবং জেলা প্রশাসকের পক্ষ হতে খাজনা নেয়ার আদেশটি বাতিল করার জন্য কয়েক দফা আবেদনও করা হয়।
এই জমির খাজনা বন্ধ করার অভিযোগে মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসকের পক্ষ হতে টেলিফোনে চাপ দেয়া হতে থাকে। অবশেষে, অনেক চেষ্টার পরে এস.এ. জরিপের মাঠ খসড়া সংগ্রহ করে এই সরকারি জমি উদ্ধার করেন এই কর্মকর্তা। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সকল প্রলোভন ও শাসকদের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে ভূমিধস্যদের হাত থেকে ২০০.৮৪ একর জমি উদ্ধার করে, রেকর্ড সংশোধন করেন, জরিপ বিভাগকে দিয়ে রেকর্ড করান এবং সরেজমিনে জমির দখল নিয়ে ভূমিহীনদের পুনর্বাসিত করেন। এই জমি জালিয়াতির সাথে জড়িত ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিয়াই সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের, বে-গ্রুপ। তাদের জালিয়াতি কার্যক্রমকে আইনগতভাবে সহায়তা করেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ. টি. ইমাম। আকবর আলীর রেকর্ড সংশোধন মামলা বাতিল করে দেয়, ততকালীন বিভাগীয় কমিশনার, রংপুর। আকবর আলী, ভূমি আপীলবোর্ডে আপীল করান। রায় হয় তাঁর পক্ষে বা সরকারের পক্ষে। পরে ভূমি খেকোদের পক্ষ হতে রিভিউ করা হয়, ফুল বেঞ্চে আকবর আলীর আদেশ বহাল থাকে। এই মালাটির বিষয়ে পূর্ণভাবে অবহিত আছেন জনাব শফিউল আলম, ততকালীন চেয়ারম্যান ভূমি আপীল বোর্ড এবং আখতার হোসেন, ততকালীন সদস্য, ভূমি আপীল বোর্ড।
আকবর আলী জানান,পীরগঞ্জ ঠাকুরগাঁয়ের ভূমিধস্যদের হাত থেকে ২০০.৮৪ একর জমি উদ্ধারের পর শেরপুরে বদলি হয়ে আসেন। এরপর ভূমি অফিসের সমস্ত কর্মচারিদের বদলী করা হয়, যাতে করে কেউ কোন তথ্য দিতে না পারে। তারপর তার বিরুদ্ধে শুরু হয় একটার পর একটা মিথ্যা অভিযোগ। একই অভিযোগে তদন্ত কর্মকর্তা পাল্টিয়ে ৩/৪ বার পর্যন্ত তদন্ত হতে লাগলো। তিনি জানান, শুধু তাকে ফাঁসানোর জন্য মন্ত্রণালয়ের একটা দুষ্ট চক্রের নির্দেশে কয়েকজন বিশেষ শ্রেণির কর্মকর্তাকে তাঁর বিরুদ্ধে এসাইনমেন্ট দিয়ে কাজ করানো হয়। অবশেষে, এলজিইডির গাছকাটার সম্পূর্ণ একটা মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তারা তার প্রমোশন স্থগিত করা হয়। যে গাছ কাটার অভিযোগে তার প্রমোশন আঁটকানো হয়, সেই গাছ কাটেন স্বয়ং এলজিইডির প্রকৌশলী। তার কোন অপরাধ হয়নি, অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আকবর আলীকে। কারণ, আকবর আলীর অপরাধ ছিল, আভিজাত্য বিবেচনা না করে চোর ধরা। তার ব্যাচমেটরা এখন অতিরিক্ত সচিব, কেউবা সচিব।অথচ ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে নানান জাতীয় দৈনিকে রিপোর্ট হলেও এমনকি তদন্তে তাদের অপরাধে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেলেও তাদের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত একটি মামলাও হয়নি। দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ হলেও, তাদের বিরুদ্ধে মামলার খোঁজ মিলেনা। সরকারি ২০০.৮৪ একর জমি নামে বেনামে সরিয়েও এই সুদাংশ শেখর বিশ্বাসদের প্রমোশনের সমস্যা হয় না। আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সরকারি জমি উদ্ধারের কারণে সত কর্মকর্তাদের প্রমোশন হয় না! চোরদের অভিভাবক আছে! সত ও প্রতিবাদি কর্মকর্তাদের অভিভাবক কারা? তারা যাবে কোথায়? আজকের ছাত্র- জনগণের সরকারের কাছে এটাই প্রশ্ন।