শফিউল আযম, বেড়া (পাবনা) সংবাদদাতা ঃ
পাবনার নদ-নদী ও বিলপাড়ে শুটকি মাছ উৎপাদন চলছে পুরোদমে। এ অঞ্চলের নদ-নদী-বিলে এবছর অঞ্চল ভেদে মাছের উৎপাদন কমেছে। দেশি প্রজাতির মাছ ধরা ও শুকানোর এই মওসুমে শুঁটকি
চাতাল মালিক ও শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। জেলায় এবার শুঁটকি মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে চাতাল মালিকরা জানিয়েছেন। এদিকে শুটকি মাছ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতের ব্যবস্থা না থাকায় বিপাকে পড়েছেন চাতাল মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
পাবনা জেলায় মোট ১৬টি নদী ও ২১২টি বিল রয়েছে। জেলার মৎস্যভান্ডার হিসেবে সুপরিচিত বৃহত্তম গাজনার বিল। ১৬টি বিল ও ৫টি নদী সমন্বয়ে গঠিত এই গাজনার বিল। গাজনার বিলের নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, পর্যাপ্ত পানির অভাবসহ নানা কারণে প্রজনন ব্যাহত হওয়ায় মাছের উৎপাদন কমেছে। তবে কাজলকুড়া, ধলকুড়া, ঘুঘুদাহ বিল, মুক্তাধর বিল, সোনাই বিল, ঘুঘুদহ বিল, জামাইদহ বিল, বড়গ্রাম বিল, খোলসাখালি বিল, কাটিয়াদহ বিল, আফড়া বিল, গাঙভাঙ্গার বিল, টেংড়াগাড়ীর বিলসহ অন্যান্য বিল ও নদীতে জেলেদের জালে মাছ ধরা পড়ছে। ব্যসায়ীরা বড় বড় মাছ ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করছে। ছোট ছোট দেশি প্রজাতির বিভিন্ন মাছ জেলেরা শুটকি চাতাল মালিকদের কাছে বিক্রি করছে। এই মাছ দিয়ে সুস্বাদু শুটকি তৈরি করা হয়।
পাবনা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মওসুমে জেলার অর্ধশত চাতালে ১৫৮ টন শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে ১৫ টন বেশি। ১৫৮ টন শুটকি উৎপাদনে প্রায় ৪৭৪ টন কাচা মাছে প্রয়োজন হয়। এদিকে চলতি শুঁটকি মওসুমে জেলার নদ-নদী ও বিলে জেলেদের জালে গত বছরের চেয়ে কম মাছ ধরা পড়ছে। ফলে শুটকি মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে চাতাল মালিকরা জানিয়েছেন। তারা জানান, মওসুমের শুরুতে বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে চাতাল তৈরি করেছেন। মাছের জন্য স্থানীয় জেলে ও ব্যবসায়ীদের অগ্রিম টাকা দিতে হয়েছে। তাদের সরবরাহ করা মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়, এ সময় ব্যবসায়ীরা সরাসরি চাতাল থেকে পছন্দের শুটকি মাছ কিনে নিয়ে যায়।
জানা যায়, শুঁটকি মাছ মান ভেদে বাছাই করা হয়। ভাল মানের শুঁটকি মাছ প্রক্রিয়াজাত করে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, বাহারাইন, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হয়। সাধারনত এসব দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিদের মাঝে রয়েছে পাবনার শুঁটকি মাছের আলাদা কদর।
তাছাড়া মাঝারি মানের শুঁটকি মাছ দেশের ভেতরে দিনাজপুর, সৈয়দপুর, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা, নারায়নগঞ্জ ও চট্রগ্রামে উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে। দিনাজপুরের শুঁটকি ব্যবসায়ী আলম সরকার জানান, পাবনার শুঁটকি মাছের মান ভালো। তাই দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাবনার মিঠা পানির শুঁটকি মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চলতি মওসুমে চলনবিলে শুটকি উৎপাদন কম হওয়ায় পাবনা অঞ্চলের শুটকি মাছের বিক্রি বেড়েছে। ফলে বিদেশে শুটকি মাছ রফতানিতে সমস্যা হবে না বলে স্থানীয় ব্যসায়ীরা জানিয়েনে।
চলতি মওসুমে জেলায় প্রায় অর্ধশত অস্থায়ী চাতালে মাছ শুঁটকি করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শুঁটকি তৈরির চাতাল মালিকরা এখানে আস্তানা গেঁড়েছেন। পানি কমতে থাকালে নদ-নদী ও বিলে জেলেদের জালে ধরা পড়ে পুঁটি, নয়না, খলসে, চেলা, টেংরা, কই, মাগুর, শিং, বাতাসি, চিংড়ি, নলা, টাকি, গুচিবাইম, বোয়াল, ফলি, কাতল, লওলা, শোল, গজারসহ নানা জাতের মাছ। এসব মাছ কিনে নিজেরা চাতালে শুকিয়ে উৎপাদন করে শুঁটকি। পরে এই শুঁটকি পাঠানো হয়, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
শুটকি মাছ ব্যবসায়ী মোঃ ফারুক শেখ জানান, পাবনার প্রায় পাঁচশতাধিক পরিবার শুঁটকি তৈরির কাজে জড়িত রয়েছেন। এসব পরিবারের নারী-পুরুষ সদস্যরা দিন হাজিরায় কাজ করছেন শুঁটকি চাতালে। কাজের ধরন অনুয়ায়ী তারা মজুরি পাচ্ছেন ৫০০ থেকে সাড়ে ৫৫০ টাকা। এ কাজ করে তারা আর্থিকভাবে সচ্ছল হচ্ছেন। শুঁটকি তৈরির কাজে নিয়োজিত মসজিদপাড়া গ্রামের গোলেজান, তাহমিনাসহ বেশ কয়েকজন নারী ও পরুষ শ্রমিক জানান, তিন কেজি তাজা মাছ শুকিয়ে এক কেজি শুঁটকি তৈরি করা হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, শৈল মাছের শুঁটকি প্রতি কেজি আকার ভেদে এক হাজার ৬০০ টাকা, চান্দা ৯০০ টাকা, বিদেশি ট্যাংরা ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা, পুঁটি ৭০০ টাকা, টাকি ৮০০ টাকা, চেলা এক হাজার টাকা, রাইয়াক ৯০০ টাকা, পাতাসি এক হাজার ২০০ টাকা, গুচি এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা, বোয়াল এক হাজার ৫০০ টাকা, চাপিলা ৮০০ টাকা, মলা ৮০০ টাকা ও বাইম এক হাজার ৪০০ টাকা দরে বেচা-কেনা হচ্ছে।
বেড়া উপজেলার কৈটোলা গ্রামের শুটকি মাছ উৎপাদনকারী মোঃ হারেছ আলী সরদার ও মোঃ হযরত আলী বলেন, দেশে-বিদেশে মিঠা পানির শুঁটকি মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। শুঁটকি উৎপাদনকারীরা স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ পাচ্ছে না। ফলে তারা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। অনেক সময় লোকসান দিয়ে শুঁটকি মাছ বিক্রি করে মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে হয়। শুঁটকি ব্যবসায়ে ঝুঁকি অনেক বেশি। ঠিকমতো শুঁটকির পরিচর্চা করতে না পারলে অনেক ক্ষেত্রে শুঁটকি মাছ নষ্ট হয়ে যায়। আর এ ধরনের সমস্যায় পড়লে মূলধন খোয়ানো ছাড়া কোন উপায় থাকে না।
এবিষয়ে পাবনা জেলা মৎম্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, গত বছর পাবনায় ১৪৩ টন শুটকি মাছ উৎপাদন হয়েছিল। এবছর ১৫৮ টন শুটকি মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে নদী-বিলে মাছ উৎপাদন কম হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত নাও হতে পারে বলে চাতাল মালিকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।