আমাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় বিশ্বের অন্যদের চেয়ে আলাদা। সুখ-দুঃখের সংজ্ঞাও আলাদা। তরুণ বয়সে নিশান নামে একটি ছবি দেখেছিলাম। মূল চরিত্রে অভিনয় করেন জাবেদ-সুচন্দা। নায়িকা সুখ পেতেন নায়কের মার খেয়ে। নায়কের হাতে একদিন চাবুকের মার না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। মার শুরু করতে, ‘মিঠা লাগে যত ব্যথা দিস রে কালা’ বলে আনন্দের গান করতেন।
গহিন অরণ্য কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত। দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গল। চোরাচালানের নিরাপদ পথ। গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার পদত্যাগের পর থেকে এ পথে দিয়ে পালাতে শুরু করেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এ পথে পালাতে চেয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত আলোচিত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকও। কলাপাতা বিছিয়ে শুয়েছিলেন। সাথে ছিল ব্রিটিশ পাসপোর্ট, ক্রেডিট কার্ড ৬০-৭০ লাখ টাকা। মারধর করে সব ছিনিয়ে নিয়েছে ছিনতাইকারীরা। কলাপাতার ওপর নিঃস্ব ও বিধ্বস্ত অবস্থায় বিজিবির হাতে ধরা পড়েন তিনি। বিজিবির প্রথম প্রশ্নে উত্তর দিয়েছিলেন,‘আমার নাম বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক’। পরিচয় পেয়ে বিজিবি তাচ্ছিল্যভাবে,‘ওই মানিক্কা যে কয়দিন আগে চ্যানেল আইয়ের উপস্থাপিকাকে…।’
হাজারো পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ছিল তার ওপর। তাই তাকে কোর্টে উঠানোকালে ডিম-জুতা নিক্ষেপসহ গণপিটুনিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
তিনি ছিলেন উচ্চ আদালতের একজন বিচারক। হাসিনা সরকারের খুদকুঁড়া খাওয়া লোকজন যে কারণে পালাচ্ছেন, সে কারণে তার পালানোর কথা নয়। কারণ, সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা মানবসভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে জাতির বিচারব্যবস্থা যত উন্নত ও স্বচ্ছ সে জাতি তত উন্নতির শিখরে আরোহণ করে। ইসলাম বিচারব্যবস্থায় সম্পূর্ণ ন্যায়ের নীতি অবলম্বনের কথা বলেছে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন মানুষের মধ্যে বিচার করবে, তখন ইনসাফের সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদের যে বিষয়ে উপদেশ দেন, তা কতই না উৎকৃষ্ট।’ (সূরা নিসা, আয়াত-৫৮)
বিচারকের চেয়ারে বসে যদি কেউ আমানত তার প্রকৃত হকদারকে না দিয়ে অন্যের হাতে তুলে দেন; সেই কৃতকর্মের কথা মনে পড়তে প্রায় অশীতিপর বয়সে রাতের আঁধারে গহিন অরণ্যে, পাহাড়-জঙ্গলের দুর্গম চোরাচালানের রুট দিয়ে পালাতে গিয়েছিলেন বিচারপতি মানিক।
শুরুতেই বলেছি, অন্যদের সুখ থেকে আমাদের সুখ-দুঃখের সংজ্ঞা একটু আলাদা। ২০২৪ সালে সুখী দেশের তালিকায় আমরা ১২৯ নম্বরে। সুখী দেশ নির্ধারণের যে কয়টি সূচক আমলে নেয়া হয় তার মধ্যে অন্যতম জিডিপি (মাথাপিছু মোট উৎপাদন), সামাজিক সহায়তা, সুস্থ জীবনযাপনের প্রত্যাশা, জীবনযাপনে সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা, বদান্যতা, দুর্নীতি নিয়ে মনোভাব ও ডিস্টোপিয়া (কল্পনার জগৎ যেখানে সঙ্কটাপূর্ণ ও নিপীড়িত)।
কিন্তু আমাদের মনোজগতে বদ্ধমূল হয়ে আছে শুধু টাকা কামানোর ধান্দা। ‘কড়ি হলে বাঘের দুধ মেলে’ এই প্রবচন ছাড়া আর কোনো প্রবচন আমাদের সমাজে অনেকে রপ্ত করতে পারেনি। যথাযোগ্য সদ্ব্যবহারের অভাবে অর্থ যে সব অনর্থের কারণ হয়ে থাকে তা একবারও মনে না তাদের। টানা সাত বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় রয়েছে ফিনল্যান্ড। তালিকায় একেবারে নিচের দিকে আফগানিস্তান। জাতিসঙ্ঘের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট -২০২৪’ বিশ্বের সুখী দেশ নিয়ে বার্ষিক এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় ১৪৩টি দেশ। এ বছরের তালিকায়ও উপরের দিক থেকে রয়েছে নরডিক অঞ্চলের দেশগুলো। একসময় ভাইকিং জলদস্যুরা ইউরোপীয় এলাকা লুটপাট করে আত্মগোপন করত নরডিক অঞ্চলে। ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড ও সুইডেন যথাক্রমে- দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ। প্রতি বছর সুখী দেশের তালিকায় প্রথম দশের মধ্যে থাকে সুইডেন। সুখের কারণ খুঁজতে ২০২২ সালে সুইডেন গিয়েছিলাম। যে এলাকায় ছিলাম সে এলাকার কাছে আলবেস্তা। ট্রেনে এক ঘণ্টার পথ। আইকিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ইঙ্গভার কামপ্রাডের জন্মস্থান আলবেস্তা। বর্তমান বিশ্বের বড় কোম্পানি আইকিয়া। দিয়াশলাইয়ের কাঠি বিক্রি দিয়ে ব্যবসায় শুরু করেছিলেন আইকিয়ার মালিক ইঙ্গভার কামপ্রাড। ২১ শতকের শেষ দিকে বিশ্বের সেরা ধনী ছিলেন ইঙ্গভার কামপ্রাড। আমাদের দেশে দু-চার ক্লাস পাস দিয়ে আমরা চাকরি খুঁজতে শুরু করি। আলবেস্তার দক্ষিণে আরো একটি এলাকা আছে, নাম মারকারাইড। মারকারাইডকে বলা হয় সুখী মানুষের দেশ। মারকারাইডের মানুষ শুধু সুখী নয়, দীর্ঘজীবীও। কাশ্মিরে হানজা নামক একটি এলাকা আছে সেখানকার মানুষ চিরতরুণ। সেখানে ৬৫ বছরের নারীদের মনে হয় ৩০ বছরের যুবতী। মারকারাইডের জনগণের কাছে সবকিছুর ব্যবহার পরিমিত পরিমাণ। পবিত্র কুরআনে সীমা লঙ্ঘন না করার বিষয়টি বহু স্থানে উল্লেখ থাকার পরও কেউ মানি না, বিশেষ করে অর্থ ও সম্পদ উপার্জনের বেলায়। মারকারাইডের লোকজন পরিমিত পরিমাণ পরিশ্রমসহ ফল-ফলাদি, সবজি খায়। এড়িয়ে চলে উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার। সর্বোপরি পারিবারিক জীবনেও পরস্পর পরস্পরের সহযোগিতায় তারা সুখী দেশের সুখী মানুষ। পথে হাঁটতে হাঁটতে জানতে চাই, আমাদের মতো চায়ের দোকানে আড্ডাসহ জমি ও বাড়ির সীমানা নিয়ে মারামারি-খুনাখুনি করে না?
আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সামনের একটি বাড়ির গেটে নিয়ে যায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। গেটে লেখা আছে ১২ নম্বর বাড়ি। বাগানে কাজ করছিল দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা (আমার চোখে)। ইচ্ছে করে তাদের সম্পর্কে কিছু জানতে। কাছে গিয়ে অনুমতি নিয়ে জানতে পারি মালিকের নাম বেংট এরিখ ব্রæনো। তার স্ত্রীর নাম লিসবেট এরিং স্ট্যাম। বয়স যথাক্রমে ৭৫ ও ৭০। চাকরি করতেন। দু’জনের সংসারে কাজের লোক নেই। এখানে এনআইডি কার্ডের মতো বাড়ির নম্বর দিয়ে সার্চ দিলে আবশ্যকীয় তথ্য জানা যায়। তথ্য নিয়ে জানতে পারি দু’জনই অবসরপ্রাপ্ত। নিজেদের বাগানে নিজেরা কাজ করেন। জীবন সায়াহ্নে এসে সুখের জন্য একটি মাত্র বাড়ি, একটি গাড়ি, একটি বাইসাইকেল। বোস্টন টেরিয়ারস জাতীয় সাত বছরের একটি কুকুর। তাদের ভিলার (বাড়ি) মূল্য আনুমানিক তিন হাজার ৬৬০ সুইডিস ক্রোনা।
একবার টেলিবোর্গ জঙ্গলে প্রবেশের আগে পাশের সাইকেল রোড দিয়ে হাঁটছিলাম। ইচ্ছে, এগিয়ে গিয়ে বনে প্রবেশ করব। সামনে বাম দিকে একটি নতুন বাড়ি হচ্ছে। বাড়ির মালিক নিজে তৈরি করছেন। নিজেই মিস্ত্রি। মনের মতো ঘর উঠাচ্ছেন। এ দেশে নতুন ঘর উঠাতে আমাদের মতো হাতুড়ি-বাটালওয়ালা প্রফেশনাল মিস্ত্রি লাগে না। সব প্রস্তুত থাকে। ট্রাকে করে এনে শুধু ফিটিং করা হয়। এখনে কেউ বড় বাড়ি তৈরি করে না। তাদের মানসিকতা হলো- যত ছোট তত সুখ। অথচ দেখুন আমাদের অবস্থা। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের ভ‚মিমন্ত্রী শুধু যুক্তরাজ্যে ৩৬০টি বাড়ি কিনেছেন। বাংলাদেশী টাকায় এ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় তিন হাজার ৮২৪ কোটি টাকার বেশি। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইয়েও তার সম্পদ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও তার সম্পত্তি আছে। সেখানে তিনি ৯টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। এর মধ্যে পাঁচটি ম্যানহাটানসহ নিউ ইয়র্কের প্রধান এলাকায় এবং চারটি নদীর ওপারে নিউ জার্সিতে।
বাড়িঘর, ধনসম্পদ সুখের মাপকাঠি নয় বলে বিশ্বের অন্যতম ধনী ও সমৃদ্ধ দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি প্রথম ২০টি সুখী দেশের তালিকায় স্থান পায়নি। এত ঐশ্বর্যের মধ্যেও দেশ দু’টিতে স্বস্তিতে নেই বিপুলসংখ্যক মানুষ।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া এবং ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিনের দুই দল বিজ্ঞানী পৃথক গবেষণায় জানান, ‘আত্মসংযম ও ইতিবাচক মনোভাব একজনকে সুখী করতে পারে।’ দুই দল বিজ্ঞানীর গবেষণার বিষয়টি ২৩ মে ২০০৩ ইত্তেফাক পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞানীদের গবেষণা ও অনুসন্ধানে যে তথ্যটি উদঘাটিত হয়েছে তা হচ্ছে- ‘ভোগ নয়, সংযম এবং ত্যাগ মানুষকে সুখী করে। ত্যাগে এবং সংযমে যে প্রকৃত সুখ সে কথা সক্রেটিস থেকে সব মনীষী ব্যক্তি একবাক্যে স্বীকার করে গেছেন।
আধুনিককালের ভোগবাদীরা সুখের সংজ্ঞা যেভাবে সাজাক না কেন, শেষ পর্যন্ত মানুষকে ফিরে আসতে হয় সাধারণ জীবনের ছোট ছোট সুখ ও আনন্দের কাছে। মানুষ যতই ছোট ছোট সুখ ও আনন্দ হারিয়ে ফেলছে ততই অসুখী হয়ে উঠছে, তত ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে জীবন। বাড়ছে চাপ, বাড়ছে টেনশন, বাড়ছে অশান্তি।
সুখের রঙ একেকজনের কাছে একেক রকম। কেউ সুখ অন্বেষণ করেন সুন্দরে, কেউ সম্পদে। কনফুসিয়াস বলেন, সুন্দর আছে সবখানে; কিন্তু সবাই তা দেখতে পায় না। সুন্দর দেখার জন্য ইতিবাচক দৃষ্টি লাগে।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক