Breaking News :

ক্ষুদ্রঋণই ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ : প্রধান উপদেষ্টা

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মাইক্রোক্রেডিটই ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ। তিনি মাইক্রোক্রেডিটের জন্য আলাদা আইন করার আহবান জানিয়ে বলেছেন, এনজিও ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে মাইক্রোক্রেডিটকে ব্যাংকিংয়ের ধারণা গ্রহণ করতে হবে। আর এ ধারণা গ্রহণ করেই ঋণগ্রহীতাকে সেবা দিতে হবে।

তিনি আরো বলেন, ‘মাইক্রোক্রেডিট এখনো এনজিও।

এই এনজিও থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। এনজিও পর্যায়ে থেকে গেলে ব্যাংকিং মেজাজ আসবে না। ব্যাংকিং মেজাজে আসতে হলে এটাকে ব্যাংক হতে হবে। মাইক্রোক্রেডিটের জন্য আলাদা আইন করতে হবে।
তিনি গতকাল শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নতুন ভবন উদ্বোধনকালে এ কথা বলেন।

গ্রামীণ ব্যাংকের শুরুর সময়কার স্মৃতিচারণা করে প্রফেসর ইউনূস বলেন, ‘আমরা যখন গ্রামীণ ব্যাংক করলাম, তখন আপত্তি উঠল এটাকে ব্যাংক বলা যাবে কি না। আমরা বললাম, আমাদেরটাই প্রকৃত ব্যাংক,  তোমাদেরটা লোকদেখানো। ব্যাংক যে শব্দ থেকে উৎপন্ন হয়েছে সেটা হলো ট্রাস্ট, তোমরা যেটা করছো সেটা ডিসট্রাস্ট।

আমাদের ব্যাংকিং মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তিতে হয়েছে। জামানতবিহীন ব্যাংক, বিশ্বাসের ভিত্তিতে আমরা টাকা দিই।’তিনি বলেন, ‘আজ এমন সময় আমরা আলাপ করছি যখন জামানতওয়ালা ব্যাংক, যারা নিজেদের প্রকৃত ব্যাংক বলে দাবি করত তাদের অনেকে আজ হাওয়া। টাকা নিয়ে লোপাট। ব্যাংক শেষ।

আর মাইক্রোক্রেডিটের পরিসংখ্যান দেখেন; কেউ পয়সা নিয়ে পালায়নি। এই হলো পরিহাস।’ 

মাইক্রোক্রেডিটই ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটাই প্রকৃত ব্যাংকিং, আগামী দিনের ব্যাংকিং, যেটাতে মানুষ নিজের পরিচয়ে কাজ করবে, নিজের বিশ্বাসের ওপর ব্যাংকিং চলবে, টাকার ওপরে না।’

মাইক্রোক্রেডিটের জন্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানান। তিনি বলেন, “গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্যের পর প্রতিটি এনজিও চেষ্টা করল একই রকম কিছু করতে। ক্রমে প্রসার হতে আরম্ভ করল। নানা রকমের নতুন নতুন জিনিস, নানা আইডিয়া নিজেদের সুবিধার জন্য ঢোকাতে আরম্ভ করল। এটা ভবিষ্যতের জন্য খারাপ হবে মনে করে একটি রেগুলেটরি অথরিটির প্রয়োজন হলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম, তারা বলল, ‘আমাদের কাজ না।’ অর্থ মন্ত্রণালয় শুরুতে গুরুত্ব দিল না, পরে বলল, ‘আচ্ছা কী করতে হবে জানাও।’ তখন আমরা বললাম, ‘রেগুলেটরি অথরিটি হওয়া দরকার, কারণ যে হারে প্রতিষ্ঠান বাড়ছে বড় রকমের সমস্যা হতে পারে।’”

প্রধান উপদেষ্টা বলেন,  ‘তৎকালীন গভর্নর ফখরুদ্দীন সাহেব আমাদের সমর্থন করলেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে এটা হতে পারবে না। তারা ব্যাখ্যা চাইল। আমি বললাম, এটা বহু দেশে বলেছি, এখনো বলি, গ্রামীণ ব্যাংকও ব্যাংক, অন্যান্য ব্যাংকও ব্যাংক। কিন্তু তফাত অনেক। উদাহরণ দিই, আমেরিকান ফুটবলও ফুটবল। ইউরোপিয়ান ফুটবলও ফুটবল। কিন্তু খেলা ভিন্ন। আপনি যদি ইউরোপিয়ান ফুটবলের রেফারিকে দিয়ে আমেরিকান ফুটবল খেলা চালাতে চান ইট উইল বি অ্য ডিজাস্টার। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দিয়ে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণ করবেন, সে তো ক্ষুদ্রঋণ জানেই না। সে তো ইউরোপীয় ফুটবলের  রেফারি।’

তিনি আরো বলেন, ‘অবশেষে ফখরুদ্দীন সাহেব রাজি হলেন। গভর্নরকে দিয়ে এটা পরিচালনা করানোর ব্যাপারেও তাঁকে রাজি করাতে হলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে এর অফিস করার আলোচনা ছিল। আমরা বললাম, আলাদা জায়গায় অফিস হতে হবে… আজ নতুন ভবন হলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা এটিকে বোঝার চেষ্টা করেছেন, নিয়ম-কানুন করেছেন। তাঁরা যদি অন্যান্য ব্যাংকের  রেগুলেটরি নিয়মের ওপর এটা স্থাপন করতেন তাহলে মাইক্রোক্রেডিট সেদিনই শেষ হয়ে যেত, আর খুঁজে পাওয়া যেত না। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।’

প্রধান উপদেষ্টা জানান, নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কে হবে এ নিয়ে শুধু বাংলাদেশ না, যে দেশেই মাইক্রোক্রেডিট হয়েছে সে দেশই সমস্যায় পড়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমি তাদের বারবার বলে এসেছি,  তোমাদের এত কিছু চিন্তা করতে হবে না। কারণ বাংলাদেশ এর সমাধান দিয়ে দিয়েছে। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি শুধু যে বাংলাদেশের জন্য কাজ করেছে তা না, এটা আন্তর্জাতিকভাবে অনেক দেশের জন্য সহায়ক হয়েছে।’

অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রেগুলেটরের ওপর কড়া না হয়ে ইউজার ফ্রেন্ডলি রেগুলেশন যেন হয় সেভাবে আইন করতে হবে। যেন কোনো কিছু চাপিয়ে না দেওয়া হয়।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের ১০ শতাংশ সমপরিমাণ সম্পদ আছে মাইক্রোক্রেডিট সেক্টরে। সবচেয়ে বড় কথা, ব্যাংকিং খাতে যে জায়গাগুলোতে দুর্বলতা আছে, মাইক্রোক্রেডিট সেই জায়গায় শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। সদস্যদের সঞ্চয়  বেড়ে ৬৮ হাজার কোটি টাকার ওপর, পুঞ্জীভূত উদ্বৃত্ত বেড়ে ৬১ হাজার কোটি টাকার ওপরে হয়েছে। এটা বড় অর্জন। তারা নিজেদের সঞ্চয় ও উদ্বৃত্ত দিয়ে নিজেদের গড়ে তুলছে। বিদেশি সহায়তা, অনুদান নেই বললেই চলে। দাতা তহবিল তিন হাজার কোটি টাকার মতো। এটা খুবই নগণ্য। বাংলাদেশে গ্রামীণ অর্থনীতি বাড়ছে। এজেন্ট ব্যাংকিং ছড়িয়ে পড়ছে। মাইক্রোক্রেডিটের শাখা আছে ২৬ হাজারের মতো। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের শাখা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। এখানে একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে ফরমাল সেক্টরের পদচারণ বাড়ছে, বাড়বে। মাইক্রোফাইন্যান্স ইনস্টিটিউটটে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হবে। মাইক্রোক্রেডিট আরো ফাংশনাল করতে রেগুলেটরি অথরিটি ও বাংলাদেশ ব্যাংক একসঙ্গে কাজ করবে।

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি নিয়ে নতুন আইনের খসড়া করা হয়েছে। সরকারের কাছে শিগগিরই নিয়ে আসা হবে বলে জানান  আহসান এইচ মনসুর।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. এম আনিসুজ্জামান চৌধুরী।

Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com