শফিউল আযম,বিশেষ প্রতিনিধি বেড়া (পাবনা)চলনবিলের তলদেশ পলি জমে জমে ভরাট হয়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এর বিশালতা। বর্ষায় সাগরের মতো বিশাল জলরাশি বুকে নিয়ে ভয়ঙ্কর রুপ ধারণ করে আবার শরতে শান্ত জলরাশির ওপর ছোপ ছোপ সাদা-সবুজ রঙের খেলা। হেমন্তে পাকা ধান আর সোঁদা মাটির গন্ধে ম-ম করে চারিদিক। শীতে হলুদ আর সবুজের নিধুয়া পাথার। গ্রীষ্মে চলনবিলের রুপ রুক্ষ। যেকোন ঋতুতে চলনবিলে মূল আকর্ষন নৌকাভ্রমন।
তবে প্রতি ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন রুপে দেখা যায় চলনবিলকে। রুপবদলের এই বৈচিত্রে হেমন্তে চলনবিল এক ভিন্ন জগৎ। বর্ষার চলনবিলের রুদ্র মূর্তি এখন শান্ত, জলরাশি স্থির। নানা রঙের ফুল, হরেক পাখির কলরব। এ যেন প্রকৃতির এক অপরুপ সাজ। তাই চলনবিলে নিরাপদে নৌকায় ভ্রমন করার জন্য শরৎ ও হেমন্তই শ্রেষ্ঠ সময়। নৌকা ভাড়া করে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতে পারেন চলনের স্বচ্ছ জলে। চাইলে মাঝিদের বলে রান্নার আয়োজন করতে পারেন নৌকায়। হেমন্তে জায়গায় জায়গায় দেখতে পাবেন ধান কাটা দেখতে পাবেন সবুজ আর সরিষার হলুদ ফুলের সমারোহ কিংবা জেলেদের মাছ শিকার।
দেখতে পাবেন বিলের পানিতে ভাসছে শত শত পাখির ঝাঁক। এরমধ্যে রয়েছে বালিহাঁস, ভূতিহাঁস, গুটি ঈগল, কুড়া ঈগল পাখি। তবে বালিহাঁসের আধিক্য সবচেয়ে বেশি। এসব পাখি ছাড়াও সাদা বক, কানি বক, পানকৌড়ি, চিল, বাজপাখিসহ দেশীয় প্রজাতির নানা পাখি রয়েছে। অধিকাংশ পাখি পানিতে নানা কায়দায় শারীরিক কসরত করছে। কিছু পাখি লেজ দুলিয়ে পোকা খুঁটে খাচ্ছে। শিকার শেষে কিছু সাদা বক খুঁটিতে বসে জিরিয়ে নিচ্ছে।
এসব দেখতে দেখতে আপনি মাঝিদের কাছে গল্প শুনতে পাবেন- এ বিলের বুকে প্রমোদতরি ভাসিয়ে একসময় রাজা-বাদশারা ক্লান্তি ঝেড়েছেন। পর্যটকরা চলনবিলের বিশালতা ধেখে অভিভূত হয়েছেন। চলনবিলের মাছে ভোজ হয়েছে অভিজাত বাড়িতে। কালের বিবর্তণে এসবের অনেকটাই এখন বিবর্ণ। বিলের তলদেশ পলি জমে ধীরে ধীরে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এর বিশালতা।
“ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া” বই থেকে জানা যায়, নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, নওগাঁ জেলার রানীনগর, আত্রাই, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বেড়া এবং বগুড়া জেলার দক্ষিণাঞ্চল মিলে চলনবিলের অবস্থান ছিল। কিন্তু ১৯১৪ সালে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেল পথ স্থাপনের পর থেকে রেল পথের উত্তর ও পশ্চিম অংশকেই চলনবিল বলা হয়। এমএ হামিদ টি,কে ১৯৬৭ সালে ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বইতে লিখেছেন, তখন থেকে প্রায় ১৪০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলময় অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের উপরে। ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপ কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, তৎকালে বিলের আয়তন ছিল ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকতো।
জানা যায়, গঠণকালে চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় এক হাজার আট বর্গকিলোমিটার। কিন্তু বর্তমানে বর্ষা মওসুমে আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার। শুষ্ক মওসুমে (মূল বিলটি) আয়তন দাঁড়ায় ১৫ দশমিক নয় থেকে ৩১ কিলোমিটার।
চলনবিল বেড়াতে গেলে পরিচয় হবে কিছু দর্শনীয় স্থানের সঙ্গে। দেখা পাবেন পাবনার চাটমোহরের শাহি মসজিদ, জগন্নাথমন্দির, বনওয়ারি নগর জমিদারবাড়ি, সিরাজগঞ্জের তাড়াশে দেখা যাবে হযরত শাহ সুফি জিন্দানি (রঃ) এর মাজার, রাধাগোবিন্দমন্দির, রশিকমন্দির, শিবমন্দির, বড় কুঞ্জবন দিঘি, উলিপুর দিঘি, মথুরা দিঘি, মাকরসন দিঘি। তাড়াশের কাছে পিঠে বিনসারা গ্রাম। সেখানে গিয়ে দেখা মিলবে কিংবদন্তি বেহুলা সুন্দরীর বাবা বাছো বানিয়া ওরফে সায় সওদাগরের ভিটা জিওন কুপ। এছাড়া নাটোরের গুদাসপুরে খুবজিপুর গ্রামে দেখা যাবে চলনবিল যাদুঘর। এখানে পাবেন চলনবিলের বিভিন্ন ঐতিহ্যময় জিনিসপত্র।