সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩২ বছর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন আন্দোলনকারীরা। তবে সরকারের সিদ্ধান্তকে সুন্দর ও যৌক্তিক বলে মনে করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা সারজিস আলম। উপদেষ্টা পরিষদে চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার বয়স নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অর্থাৎ, অবসরের বয়স এখন যা আছে, তাই থাকবে।
গতকাল রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বয়স-সংক্রান্ত এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সভায় ‘সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাসমূহে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা নির্ধারণ অধ্যাদেশ, ২০২৪ ’-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমার বিষয়টি রয়েছে।
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
এর আগে এ সংক্রান্ত পর্যালোচনা কমিটি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা পুরুষের ক্ষেত্রে ৩৫ বছর এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৩৭ বছর করার সুপারিশ করেছিল। তবে চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার বয়স নিয়ে কিছু বলেনি ওই কমিটি।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য কমিটি গঠন করে সরকার। এ কমিটির প্রধান করা হয় সাবেক সচিব আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীকে, যিনি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান।
বর্তমানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সাধারণ বয়স ৩০ বছর। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় আবেদনের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩২ বছর। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিল একদল চাকরিপ্রত্যাশী।
এ অবস্থায় উপদেষ্টা পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) সব ক্যাডারের চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩২ বছর নির্ধারিত হবে। বিসিএসের আওতাবহির্ভূত সব সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রেও একই বয়স নির্ধারিত হবে। আর স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার ক্ষেত্রে নিজ নিজ নিয়োগ বিধিমালা প্রয়োজনীয় সংযোজন সাপেক্ষে এ বয়সের বিষয়টি প্রযোজ্য হবে। তবে প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগগুলো এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষেত্রে স্ব স্ব নিয়োগ বিধিমালা বহাল থাকবে।
বিসিএস পরীক্ষা দেওয়া যাবে সর্বোচ্চ তিনবার
বিসিএস পরীক্ষায় একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ তিনবার অংশ নিতে পারবেন। খসড়া অধ্যাদেশের আলোকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিসিএস (বয়স, যোগ্যতা ও সরাসরি নিয়োগের জন্য পরীক্ষা) বিধিমালা, ২০১৪ পুনর্গঠন করে বিসিএস পরীক্ষায় একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ তিনবার অবতীর্ণ হতে পারবেন- এমন বিধি সংযোজন করার সিদ্ধান্ত উপদেষ্টা পরিষদের।
৩২-এর ওপরে যাওয়ার সুযোগ নেই
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, সবদিক বিবেচনায় নিয়ে আমাদের মনে হয়েছে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২-এর উপরে যাওয়ার সুযোগ নেই। গত রাতে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক বিফ্রিংয়ে তিনি এ কথা বলেন তিনি।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, যেসব যুক্তি দিয়ে বলা হচ্ছে সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা ৩৫ করতে হবে, যেমন- করোনা, আন্দোলন ইত্যাদি, সেগুলো অস্থায়ী কারণ। আমরা দেখেছি, যেহেতু বিসিএসের প্রতি অনেকের আগ্রহ থাকে, অনেক দূর বাড়িয়ে দিলে একজনই বারবার এখানে পরীক্ষা দেয়, অন্যদের জন্য সুযোগ সীমিত হয়ে যেতে পারে। এটার কিছু অর্থনৈতিক বিষয়ও আছে। এগুলো হচ্ছে স্থায়ী বিষয়। এগুলো চিন্তা করে বয়স ৩২ রাখাটা সমীচীন।
বিসিএস পরীক্ষা তিনবার দিতে পারবে মানে তিনবারই, উল্লেখ করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আগে যারা পরীক্ষা দিয়েছেন তাদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত, এটা একটা লিগ্যাল বিষয়। যখন অধ্যাদেশটি চূড়ান্ত হবে তখন এই আইনি বিষয়গুলো স্পষ্ট করা হবে। আজ শুধু নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্ত আর পরিবর্তন করা হবে না। আন্দোলন তো হতেই পারে। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনাও হতে পারে। ৩৫-এর পক্ষে যেমন আন্দোলন আছে, এর বিপক্ষেও আন্দোলন আছে।
বয়সসীমা ৩২ প্রত্যাখ্যান ৩৫ প্রত্যাশীদের : সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়েছে সরকার। তবে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীদের প্ল্যাটফর্ম ‘বয়সসীমা ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদ’।
একই সঙ্গে স্থায়ীভাবে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে তাৎক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলনে বয়সসীমা ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক মো. শরিফুল হাসান শুভ এ ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, আমরা সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩৫ করার জন্য ১২ বছর ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছি। গত ৩০ তারিখে এ সংক্রান্ত যে সুপারিশ করা হয় তাতে আমাদের দাবির প্রতিফলন ঘটে, সরকারকেও ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু আজকে সরকার জানিয়েছে এটি ৩২ বছর করা হয়েছে।
শরিফুল হাসান বলেন, আমরা এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করছি। আমরা আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারের বোধোদয় হবে এবং চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করা হবে।
এ সময় তিনি অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, দীর্ঘ ১২ বছর ধরে আন্দোলন করলেও কোনো সরকারই এমন আন্তরিকতার সঙ্গে চাকরির বয়স বাড়ায়নি। সেক্ষেত্রে বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে সরকারকে বলব, বিষয়টি পুনরায় বিবেচনায় নিয়ে স্থায়ী করে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করে দেওয়ার জন্য।
তিনি জানান, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হবে।
সরকারে সিদ্ধান্ত যৌক্তিক : বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে ৩২ বছর করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের মতামত জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা সারজিস আলম। গতকাল নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে সারজিস আলম লেখেন- ‘সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ নির্ধারিত করে প্রজ্ঞাপন জারি। এটাই সবচেয়ে সুন্দর ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত।’
বয়স ৩৫ করার পক্ষে প্রশাসন ক্যাডার : প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ৩৫ বছর ও অবসরের বয়স ৬৫ বছর করার দাবি জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দিয়েছিল।
৩৩ বছর করার প্রস্তাব : সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স প্রাথমিকভাবে আগামী দুই বছরের জন্য ৩৫ বছর করে পরবর্তী বছর থেকে স্থায়ীভাবে ৩৩ বছর করার প্রস্তাব জানায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এ ছাড়া অবসরের সময়সীমা ৬২ করার প্রস্তাব জানায় দলটি। সেই সঙ্গে সরকারি চাকরিপ্রার্থীরা যেন বিনামূল্যে আবেদন করতে পারে সে দাবিও জানিয়েছিল জামায়াত। ৯ অক্টোবর দুপুরে হোটেল ওয়েস্টিনে জামায়াতের আমিরের পক্ষ থেকে ‘রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনা’ উপস্থাপন করেন দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের।
সূত্রঃ আমাদের সময়