শফিউল আযম, বেড়া (পাবনা) দেশের প্রচলিত আইন অমান্য করে পাবনা জেলায় কৃষিজমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হচ্ছে। জমির উপরিভাগের মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে ইটভাটায়। রাতের আধারে কৃষিজমিতে খনন করা হচ্ছে পুকুর। প্রতি বছর কৃষিজমির বড় একটি অংশ চলে যাচ্ছে বানিজ্যিক পুকুর খননে। মাছচাষে লাভ বেশি হওয়ায় কৃষিজমিতে পুকুর খনন করছেন মালিকরা। আর এ লাভজনক ব্যবসায় যুক্ত আছেন স্বস্ব এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা যায়, জমির উপরিভাগের মাটি কেটে নেয়ায় দীর্ঘ মেয়াদি জলাবদ্ধতায় কমতে শুরু করেছে ফসল উৎপাদন। এছাড়া মাটিভর্তি ও খালি ট্রাক চলাচলের কারণে গ্রামীণ কাঁচা-পাকা সড়ক নষ্ট হচ্ছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের যোগসাজশে ইটভাটার মালিক ও মাটি ব্যবসায়ীরা কৃষকদের অর্থের লোভ দেখিয়ে তিন-চার ফসলি জমির মাটি কেটে বানিজ্যিক পুকুরে পরিনত করছে।
১৯৮৯ সালের ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রন আইন ( সংশোধিত ২০০১) অনুযায়ী, কৃষিজমির টপ সয়েল বা উপরিভাগের মাটি কেটে শ্রেণি পরিবর্তন করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে। এ কাজে জড়িত ব্যক্তিদের দুই লাখ টাকা জরিমানা এবং দুই বছরের কারাদন্ড দেয়ার বিধান আছে। এ ক্ষেত্রে এ কাজের সাথে জড়িত জমি ও ইটভাটার মালিক উভয়ের জন্যই সমান শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
কিন্তু এই আইন অমান্য করা হচ্ছে। জেলার ৯টি উপজেলায় অবাধে চলছে জমির মাটি কাটার ঘটনা। মাটি কাটা হচ্ছে স্কেভেটরে (ভেকু মেশিন)। পরে ট্রাকে করে মাটি সরবরাহ করা হচ্ছে ইটভাটাসহ বিভিন্ন জায়গায়। চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, বেড়া, সুজানগর, সাঁথিয়া,আটঘড়িয়া, ঈশ্বরদী উপজেলায় কৃষিজমি কেটে বানিজ্যিক পুকুর খনন করা হয়েছে। এরমধ্যে সাঁথিয়া ও চাটমোহর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি পুকুর খনন করা হয়েছে, হচ্ছে। পুকুর খননের কারণে আশপাশের জমি ভাঙনের মুখে পড়েছে। তাছাড়া মাটিবোঝাই ট্রাক চলাচল করায় সড়কগুলোতে খানাখন্দের সৃষ্টি হচ্ছে।
কৃষিজমিতে শত শত পুকুর খনন করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। মাছের উৎপাদন বাড়ায় সাফল্য হিসেবে দেখছে মৎস্য বিভাগ। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, বানিজ্যিক এসব পুকুর খনন করা হয়েছে আবাদি জমিতেই। অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খননে জলাবদ্ধতায় প্রতিবছরই ফসলহানি হচ্ছে। চাপ বাড়ছে খাদ্যনিরাপত্তা ও পরিবেশের ওপর।
পাবনা মৎস্য বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭ সালে জেলায় পুকুরের পরিমান ছিল সাড়ে ৬ হাজার হেক্টর। এরমধ্যে বানিজ্যিক মাছের খামার ছিল তিন হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে। ২০২২ সালে এসে বানিজ্যিক খামার গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার হেক্টরে। গত কয়েক বছর ধরেই চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, সাঁথিয়া, সুজানগর বেড়া উপজেলা এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে ফসলী জমিতে পুকুর খননের মহোৎসব চলছে।
অভিযোগ উঠেছে, এ কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগীতা করছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও পুলিশ। পুকুর খনন বন্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় কিছু কিছু অসাধু ব্যক্তি আবাদি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন করছে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতের আধারে ভেকু মেশিন দিয়ে চলছে পুকুর খননের মহোৎসব। হারিয়ে যাচ্ছে গোচারন ভূমি। এতে কমছে কৃষিজমি, বাড়ছে কৃষিশ্রমিকের বেকারত্ব। ভেঙ্গে পড়ছে গ্রামীণ নিরাপত্তা বেষ্টনী। এরফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব পড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রেণি পরিবর্তন করে আবাদযোগ্য জমিতে পুকুর খননের সুযোগ নেই আইনে। তারপরও এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি নানান কৌশলে পুকুর খনন করে যাচ্ছে। বিশেষ করে বিল ও নিচু এলাকাগুলোকে অনাবাদি বিংবা এক ফসলি দেখিয়ে পুকুর খনন করছেন তারা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক এবিএম মহসিন বলেন, কোন এলাকায় কতগুলো পুকুর প্রযোজন আছে এবং পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে? সেসব বিবেচনা না করেই যথেচ্ছভাবে পুকুর খনন করা হচ্ছে। এসব অপরিকল্পিত পুকুরে কৃষকের জীবন ও জীবিকা হুমকীতে পড়ছে।
পরিবেশ আইনজীবী তন্ময় সান্যাল বলেন, ভূমি ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইনগুলোতে ভূমির ধরণ রুপান্তর করা নিষিদ্ধ। তাছাড়া ২০১৩ সালের বাংলঅদেশ পানি আইনের প্রাকৃতিক জলাশয়ের প্রবাহকে বাধা দেয়া কঠোরভাবে নিষেধ করা আছে। কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনের খসড়া, যেখানে পরিস্কারভাবে কৃষিজমি রুপান্তর নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ আছে, সেটি এখনও পূর্ণতা পায়নি।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) উপ-পরিচালক ড. মোঃ জামাল উদ্দিন বলেন, জেলায় গত কয়েক বছরে পুকুরের কারণে অনেক ধানিজমি কমেছে। তবে সরকারি নির্দেশনা থাকার পরেও পুকুরগুলো কিভাবে গড়ে উঠছে? সেটি বলতে পারবো না। জেলায় গত কয়েক বছরে মোট কী পরিমান ফসলি জমি পুকুরের কারণে নষ্ট হয়েছে? এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর জানাতে পারেননি তিনি।
পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, গত কয়েক বছরে পাবনা জেলায় মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুন। গত ১০ বছরের মধ্যে পুকুর সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ। মাছ চাষ করে অনেক বেকার যুবক স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মাছ চাষের জন্য চাষিদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ফলে জেলায় এখন মাছ উদ্বৃত্ত থাকছে। যা দেশের বিভিন্ন জেলায় রফতানি করা হচ্ছে।
পুকুর খনন বিষয়ে জানতে চাইলে সাঁথিয়া উপজেলা সহকারি কমিশনার ভূমি সাদিয়া সুলতানা বলেন, সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে পুকুর খনন করা যাবে না। এ বিষয়ে আমাদের অভিযান চলমান আছে। ইতিমধ্যে অনেককে জরিমানাসহ আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
প্রকাশক ও সম্পাদকঃ মোঃ বদরুল আলম -০১৭১২৯৫৭০৬৬,
নির্বাহী সম্পাদকঃ সফিক ইসলাম,-০১৭১৬৪৯২৪১৫,
বার্তা সম্পাদকঃ আব্দুর রহিম-০১৭১৫৮৪৪১৬২
Copyright © 2024 Protidinerjonopod