পাবনার ভাঙ্গুড়ায় ৫ দোকান-বাড়িতে ডাকাতি: ৪০ ভরি সোনা,২০ লক্ষ টাকা লুট
‘কর’ সাহেবের খিদে বাড়ছে গরিব লোক তালিয়া বাজাও

মাহফুজুর রহমান
সরকার চালাতে টাকা লাগে। দেশে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বাড়াতে হয়; তাই সরকারের আরও বেশি টাকা লাগে। রাস্তাঘাট মেরামত করতে গেলে আরও বেশি বেশি টাকা লাগে। সেই টাকা আয় করতে বাজেটের সময় মাঠেঘাটে কর বসিয়ে দেওয়া হয়। বাজেট ছাড়াও কর বসানো যায়। সংসদ ছাড়াও কর বসানো যায়। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি করে কর বাড়ানোর ইতিকথা এ দেশেও বিদ্যমান।
বর্তমান সরকারও কর বাড়াতে যাচ্ছে। হু হু করে এগিয়ে যাওয়া মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলাতেই সম্ভবত এই করারোপ হতে যাচ্ছে। সরকারের আয় বাড়ানোর জন্য কর, ভ্যাট বা সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর খাতগুলোর নির্বাচন হয়েছে চমৎকার। এই করারোপের ফলে গরিবের শরীরে আঁচড়টিও লাগবে না।
কর বাড়ছে শুনে আমি কিছুক্ষণের জন্য ‘টাসকা’ মেরে ছিলাম। নিজেকে এখনও মধ্যবিত্ত বলেই মনে করি। সংসার চালানোর বিপত্তি সামনে আরও বাড়বে, গৃহকর্ত্রীর মুখ ঝামটাও বাড়তে পারে। গরিবের কী অবস্থা জানার জন্য আবুল মিয়াকে ফোন দিলাম। আবুল মিয়া গ্রামের মানুষ, সামান্য লেখাপড়া জানে। তবে সে গরিবের গরিব, হদ্দ গরিব। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ প্রবাদটি তার বেলায় প্রযোজ্য নয়। কারণ তার ঘরে পান্তাও নেই; সুতরাং নুন কেনার কোনো প্রশ্ন ওঠে না।
কর বাড়ানোর খবর শুনে আবুল মিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এরপর জানতে চাইল, কোন কোন খাতে কর বাড়ানো হচ্ছে?
আমি পত্রিকাটা হাতে নিয়ে জানালাম, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁয় রসনা বিলাস করতে গেলে শতকরা ৫-এর বদলে শতকরা ১৫ টাকা ভ্যাট দিতে হবে। আমার কথাটা আবুল মিয়া ভালো করে বুঝতে পারল না। সে বলল, কথাডা একটু সহজ কইর্যা বুঝায়া কন তো ভাইজান।
আমি বললাম, যেসব খাবারের দোকানের ভেতরটা গরমের দিনে ঠাণ্ডা রাখার ব্যবস্থা আছে, সেসব দোকানে খেতে গেলে আগের চেয়ে আরও শতকরা ১০ টাকা বেশি দিতে হবে।
আবুল মিয়া লাফিয়ে উঠে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আমার শরীরে লাগে নাই। বাড়ির দক্ষিণে আমগাছের নিচে ফুরফুরে ঠাণ্ডা বাতাস লাগিয়ে দূর্বাঘাসে বইস্যা খাইলে যখন কর নাই তখন আমরা খুব খুশি আছি। যারা ঢং করতে শীতে-তাপে অদলবদল কইর্যা ভাত খায় তারা সরকারকে ভ্যাট দেবে, এতে গরিবের কী!
দোকান থেকে কাপড় কিনলে শতকরা সাড়ে সাতের বদলে শতকরা ১৫ টাকা ভ্যাট দিতে হবে। মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি কিনলে বা যে কোনো নন-এসি হোটেলে খেলে একই হারে বাড়তি ভ্যাট গুনতে হবে।
আবুল মিয়া একটা চিৎকার দিয়ে উঠল। বলল, গরিব লোক তালিয়া বাজাও। এবারও গুলি আবুল মিয়ার শরীরে লাগেনি। সে কাপড় কেনে (যদি কখনও কেনার মতো পয়সা থাকে) মুড়িপট্টির পাশে মফিজ বাউলের ফুটপাতের টাল থেকে। এখানে ভ্যাটের কোনো বালাই নেই। আর মিষ্টি কিনে খাওয়া তো দূরের কথা, হোটেলের চেয়ার-টেবিলে বসে খাওয়াও তার চলে না। রাস্তার টং দোকান থেকে বা ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো দোকান থেকে দু-চার টাকার খাবার কিনে সে খায়। আর টিউবওয়েল থেকে সরাসরি খাঁটি পানি খেয়ে নেয়। আবুল মিয়া হঠাৎ করেই কেন জানি ভয় পেয়ে গেল। সে আমার কাছে জানতে চাইল, ভাইজান, সরকারি লোক এখন থেইক্যা টং দোকানের পাশে ভ্যাটের খাতা লইয়া দাঁড়ায়ে থাকব না তো?
আমি তাকে আশ^স্ত করলাম, মনে হয় না। সরকার এতটা উন্নত আয়োজন মনে হয় এখনই করতে পারবে না। আমি আরও বললাম, কর-ভ্যাট বাড়ছে এমন আরও আইটেম আছে।
-এগুলি আবার কোনগুলি ভাইজান?
আবুল মিয়ার গলায় শঙ্কার চিহ্ন।
আমি বললাম, এগুলো হলো বিস্কুট, আচার, সিআর কয়েল, ম্যাট্রেস, ট্রান্সফরমার।
আবুল মিয়া খুশিতে লাফাতে শুরু করেছে।
-লাগে নাই, লাগে নাই। যত ইচ্ছা তত কর লাগাও। আমরা বাঁইচ্যা গেছি।
আমি কিন্তু নাছোড়বান্দা। গরিবের গায়ে না লাগাতে পারলে ক্ষমতায় থাকা গরিবের বন্ধুদের সহানুভূতি পাব কেমন করে? আমি আবার বললাম, এত লাফিও না। বেঁচে যাওনি। টিস্যু পেপারের ওপরও ভ্যাট বসছে নতুন করে। অতএব দাম বাড়বে।
আবুল মিয়া তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাঃ হাঃ করে একটা হাসি দিল। বলল, ভাইজান এসব কী কথা কন? আমরা কি টিস্যু পেপার কিনি? আমাদের জন্য মাটির কুলুক আছে না?
-ভাত খাওয়ার পরে হাত-মুখ মোছার বুদ্ধি কী? টিস্যু পেপার তো লাগবেই।
-কী যে কন ভাইজান! লুঙ্গি উল্টা কইর্যা আমরা মুখ মুছি, হাত মুছি, মাথাও মুছি।
আমি একটুখানি ঘাবড়ালাম। কী আশ্চর্য! এভাবে গরিব বাঁচিয়ে কর বৃদ্ধি? শেষ চেষ্টা একবার করাই যাক। বললাম, আবুল মিয়া, আরও কর বেড়েছে। আকাশপথে উড়াল দিলেই অতিরিক্ত কর দিতে হবে। বাংলাদেশের ভেতরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অথবা সার্কভুক্ত যে কোনো দেশের উদ্দেশে উড়াল দিতে গেলে সরকারকে কর দিতে হবে ৭০০ টাকা; এটা আগে ছিল ৫০০ টাকা। সার্ক ছাড়া এশিয়ার অন্য কোনো দেশে গেলে দুই হাজারের জায়গায় আড়াই হাজার এবং ইউরোপ ও আমেরিকার কোনো দেশে গেলে আগের তিন হাজারের বদলে এখন চার হাজার টাকা কর দিতে হবে।
আবুল মিয়া লাফাতে লাফাতে এখন হাঁফাচ্ছে। সে বলল, লাগে নাই, লাগে নাই। গরিবের শরীরে লাগে নাই। গরিব কবে কখন উড়াল দিছিল? উড়াল দেওয়া তো বড়লোকদের কাম। আমরা তো উড়াল দেখি। পাখি উড়াল দেয়, বড় মানুষরা উড়াল দেয়। আবার শুনছি সরকারের কাছ থেকে চুরি করা টাকাও উড়াল দেয়।
আমি অনেকটাই চুপচাপ আছি। মুখে কথা সরছে না। কোপগুলো সব মধ্যবিত্তের মাথায় এসে পড়ছে। গরিব বেঁচে গেছে। ধনীদের শরীরের চামড়া অনেক মোটা, সামান্য কর-ভ্যাট তাদের শরীরে লাগার কথা নয়। লাগেও না। অনেক কষ্টে আবুল মিয়ার লম্ফঝম্প থামিয়ে বললাম, আরও আছে। সম্পূরক শুল্ক বাড়বে অনেকগুলো পণ্যে। এর মধ্যে এক নম্বর হচ্ছে মদ। বিদ্যমান শতকরা ২০ থেকে বাড়িয়ে শতকরা ৩০ ভাগ করা হয়েছে সম্পূরক শুল্ক।
আবুল মিয়া বলল, আলহামদুলিল্লাহ। মদ খাওয়া মহাপাপ। মদের ওপর কর আরও বাড়ানো হোক।
আমি বললাম, ফলের রস আমদানিতে সম্পূরক কর বর্তমান শতকরা ২০ থেকে বাড়িয়ে শতকরা ৩০ ভাগ করা হয়েছে।
আবুল মিয়া বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আমদানি কইর্যা ফলের রস খাওয়ার দরকার কি? দেশে কত রংবেরংয়ের ফল আছে। এগুলো খাই। আল্লাহ আমাদের দেশের জন্য যে ফলগুলো দরকার সেগুলোই দিয়েছেন। বিদেশ থেইক্যা ওষুধ লাগানো ফল আনবার কোনোই দরকার দেখি না। মাফ করবেন ভাইজান, ছোডু মুখে বড় কথা কইয়া ফেললাম।
আমি বললাম, রং আমদানি করতে গেলেও সম্পূরক শুল্ক বাড়বে।
আবুল মিয়া বলল, বাড়ুক গিয়া। রঙের দরকার কী? জিনিসপত্রের দাম যা বাড়ছে, মনের মধ্যেই রং চইল্যা গেছে। রং আমদানি কইর্যা আর কী অইবো?
আমি বললাম, তামাক আমদানি করতে গেলেও সম্পূরক শুল্ক বাড়বে।
আবুল মিয়া বলল, বাড়ুক, বাড়ুক। বিড়ি-চুরুট ছাইড়্যা দিছি। এগুলি খাইলে নাকি ক্যানসার হয়। দাম বাড়ে বাড়ুক। গরিব লোক জোরসে তালিয়া বাজাও।
আমি এতক্ষণে মরিয়া হয়ে উঠলাম। একটি পণ্যেও গরিবকে ধরানো গেল না। আমি এবার বললাম, সুপারি আমদানি করতে গেলেও সম্পূরক শুল্ক বাড়বে। অর্থাৎ সুপারির দাম বাড়বে।
এবার মনে হয় আবুল মিয়ার গায়ে একটু লাগল। সে বলল, কী বললেন ভাইজান? আমাদের বিলাসিতা বলতে তো একটু সুপারি খাওয়া, তাই না! এর দামও বাড়বে? পেটে ঠিকভাবে ভাত না দিতে পারলেও মুখটা থাকে লাল। চাকুমচাকুম করে মুখটা নাড়াচাড়া করি। জর্দার সুবাসে চারদিকটা সুবাসিত হয়। লোকে ভাবে পেট ভরে ভাত খেয়েছি। আমাদের সেই বিলাসিতাটুকুও কেড়ে নেওয়া হবে ভাইজান?
এবার পেয়েছি আবুল মিয়াকে। ‘গরিব লোক তালিয়া বাজাও’ আর বলবে? আমি বললাম, জর্দা বানাতে কিন্তু তামাক লাগে। দাম বেশি দিয়ে কিনে আনা তামাক দিয়ে জর্দা বানালে জর্দার দামও বাড়বে।
আবুল মিয়ার হাসি বন্ধ হয়ে গেল। তালিয়া বাজানো বন্ধ হলো। আমি মধ্যবিত্ত দাবি করি বলে আমার দুশ্চিন্তা ছিল। এখন বুঝলাম, মূল্যবৃদ্ধির ছোবল থেকে গরিবেরও রেহাই নেই।
মাহফুজুর রহমান : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক